
বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গৌরবময় অংশ ছিল তামা, কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্র। রান্নাবান্না, খাবার পরিবেশন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কিংবা পানীয় সংরক্ষণ-প্রতিটি ঘরোয়া প্রয়োজনে একসময় অপরিহার্য ছিল এসব ধাতব সামগ্রী। গাইবান্ধাসহ দেশের নানা অঞ্চলে প্রতিটি পরিবারের নিত্যসঙ্গী ছিল কাঁসার থালা, বাটি, জগ, গ্লাস ও চামচ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক, স্টিল ও মেলামাইনের সস্তা বিকল্পের কাছে হার মানছে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প। কমছে চাহিদা, হ্রাস পাচ্ছে উৎপাদন। ফলে বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে এক সময়ের গৌরবময় এই ঐতিহ্য।
আরো পড়ুন: গোবিন্দগঞ্জে ৫ কেজি গাঁজা সহ দুই নারী মাদককারবারি গ্রেফতার
গাইবান্ধার পুরাতন বাজার এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল হান্নান বলেন, ১৫-২০ বছর আগেও ঈদ-পূজা বা বিয়ের মৌসুমে কয়েক ট্রাক কাঁসার থালা-বাটি বিক্রি হতো। এখন সারা মাসে কয়েকটা জিনিসও বিক্রি হয় না। মানুষ প্লাস্টিক আর স্টিলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
স্থানীয় এক কারখানার মালিক নুরুল ইসলাম জানান, তামা-কাঁসার কাজ করতে প্রচুর শ্রম ও সময় লাগে। দামও বেশি পড়ে। অথচ প্লাস্টিক বা মেলামাইনের জিনিস সস্তায় সহজলভ্য। ফলে ক্রেতারা আর কাঁসার জিনিস কিনতে চান না। তার কারখানায় আগে ২০ জন শ্রমিক কাজ করলেও বর্তমানে টিকে আছেন মাত্র ৩ জন।
গাইবান্ধা শহরের পার্ক রোড এলাকার ‘উপহার বিতান’-এর মালিক আশুতোষ রায় বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে আমার কারখানা ছিল কালিবাড়ি পাড়ায়। প্রতিদিন ১০০ থেকে দেড়শ হাড়ি তৈরি হতো। তখন টেলিফোনে অর্ডার নিতে হতো। এখন মাসে দশটা অর্ডারও আসে না। তবুও ঐতিহ্যের টানেই এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।.

আরো পড়ুন: গাইবান্ধায় বিএডিসি সেচ প্রকল্পে ঘুষ-বাণিজ্য
কারিগর আব্দুস সাত্তার আক্ষেপ করে বলেন, আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কাজ করে আসছি। কিন্তু এখন কাজ না থাকায় অনেকে পেশা বদল করে দিনমজুরি করছেন। সরকারি সহায়তা না পেলে এই শিল্প একেবারেই হারিয়ে যাবে।
তবে এখনও অভিজাত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কাঁসার থালায় খাবার পরিবেশনকে আতিথেয়তার অংশ হিসেবে ধরে রেখেছেন। এসব তৈজসপত্রের রয়েছে বৈচিত্র্যময় নাম ও নকশা। যেমন-থালায় কাস্তেশ্বরী,রাজভোগী,জগে ‘কৃষ্ণচূড়া,ময়ুর আঁধার, বাটিতে রামভোগী,গোলবাটি,আর চামচে বোয়াল মুখী,চাপিলামুখী। একসময় পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গলঘট ও কাঁসার বাদ্যযন্ত্রও ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়, যা এখন সীমিত হয়ে এসেছে বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, তামা-কাঁসার ঐতিহ্য রক্ষায় কারিগরদের প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ সুবিধা, কাঁচামালের সরবরাহ ও বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নইলে অচিরেই ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে বাংলার এক সময়ের গৌরবময় এই শিল্প।